বাংলাদেশে সদ্য শেষ হওয়া সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ীদের শপথ গ্রহণের জন্য বৃহস্পতিবার তারিখ নির্ধারণ করেছে সংসদ সচিবালয়।
এদিন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের মহাজোটের শরীক দলগুলোর বিজয়ী সদস্যরা শপথ নেবেন বলে জানা যাচ্ছে।
তবে বিরোধী বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী প্রার্থীরা শপথ নেবেন কি-না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। যদিও দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা শপথ গ্রহণ করবেন না। নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিতে বৃহস্পতিবার ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু একটি বিষয় এখনো পরিষ্কার নয় যে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কারা হচ্ছে?
যে কারণে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাহলো নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”সরকার গঠন করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকতে হবে, এটা সংবিধানে বলা আছে। যে দল রাষ্ট্রপতির কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে প্রতীয়মান হবে, সেই দলের নেতাকে উনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেবেন। আর অনাস্থা ভোটের বিষয়ে বলা হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু বলা নেই।”
তিনি বলছেন, সারা দুনিয়াতে প্রথা যে সরকারি দলের পর যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই দলই বিরোধী দল হবে এবং সেই দলের নেতা বিরোধী দলের নেতা হবেন। সেখানে তাদের কতটি আসন থাকতে হবে, এ রকম কোন বিষয় কখনো নজরে পড়েনি।”
তবে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছিল ২৯৩টি আসন। আর বিরোধী ছোট ছোট কয়েকটি দল মিলে পেয়েছিল বাকি সাতটি আসন। সে সময় এসব দল যৌথভাবে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খানকে তাদের নেতা উল্লেখ করে বিরোধী দলের নেতার মর্যাদা দেয়ার জন্য স্পিকারের কাছে আবেদন জানান।
তবে তৎকালীন সংসদ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেন, বিরোধী দল হিসাবে স্বীকৃতি পেতে হলে একটি রাজনৈতিক দলের অবশ্যই ২৫টি আসন থাকতে হবে। নাহলে তাদেরকে পার্লামেন্টারি গ্রুপ হিসাবে বলা যেতে পারে, কিন্তু বিরোধী দল নয়। এখনো সেই ধারাটি অব্যাহত রয়েছে।
শাহদীন মালিক বলেন, ”সেটা যদি সংসদে রেজুলেশন (সিদ্ধান্ত প্রস্তাব) আকারে নেয়া হয়ে থাকতো, তাহলে সেটাই সংসদকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হতো। কিন্তু সেটা রেজুলেশন নেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।”
সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জাসদের আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন বিরোধী মোর্চা সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) সব মিলিয়ে পেয়েছিল ১৯টি আসন। সেই জোটকে নিয়েই বিরোধী দলের নেতার আসনে বসেছিলেন মি. রব।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সংসদের বিরোধী দল বিএনপির মোট আসন ছিল ৩০টি। দলটি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৪টি আসনে বিজয়ী হয়ে একই সঙ্গে যেমন সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়, তেমনই আবার সংসদের বিরোধী দল হিসাবে হিসাবেও দায়িত্ব পালন করে।
তবে ২০১৮’র নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি কি সরকারে থাকবে, না-কি বিরোধী দল হবে, না-কি আগের মতোই দুই ক্ষেত্রে রয়ে যাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
জাতীয় পার্টির নেতা জিএম কাদের বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা মহাজোটে আছেন, মহাজোটে থাকতে চান। তবে ভবিষ্যতে অবস্থা বুঝে ‘দেশের স্বার্থে’ কোন প্রয়োজন হলে তখন বিকল্প দেখা হতে পারে বলে জানাচ্ছেন দলটির এই নেতা।
শাহদীন মালিক বলছেন, মহাজোটে থাকলেও বা নির্বাচনী একটি জোটে থাকলেও জাতীয় পার্টি যেহেতু নিজেদের প্রতীকে অর্থাৎ লাঙ্গল নিয়েই নির্বাচন করেছেন, অতএব এক্ষেত্রে তাদের বিরোধী দল হতে কোন সমস্যা তিনি দেখেন না। তবে যারা নৌকা প্রতীকে জোট শরীক হিসাবে নির্বাচন করেছেন, তারা আর বিরোধী দলে যেতে পারছেন না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তবে একই সঙ্গে সরকারি দলের মন্ত্রী আবার বিরোধী দলের সদস্য হওয়ার নজীর আর কোন দেশে আছে কিনা, তা তার জানা নেই বলে তিনি জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় পার্টি যদি পুরোপুরি সরকারের অংশ হয়ে যায়, তখন পরবর্তী সর্বোচ্চ আসন পাওয়া দলটির বিরোধী দলে পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
সাবেক স্পিকার ও বিএনপি নেতা জমিরউদ্দিন সরকার বলছেন, ”সংসদের নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া দলটি বিরোধী দল হবে।”
এই নির্বাচনে বিএনপি পাঁচটি আসন পেয়েছে, আর তাদের জোট সঙ্গীরা পেয়েছে আরও দুটো আসন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের বিচারে জাতীয় পার্টির পরেই তাদের অবস্থান। তবে দল বা জোটটি সংসদে যাবে কি-না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
প্রশ্ন হলো, বিএনপির বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু আছে?
সাবেক স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার বলছেন, ”এক্ষেত্রে তাদের জাতীয় পার্টি বা অন্যদের সমর্থন দরকার হবে। জাতীয় পার্টি যদি নিজেরা বিরোধী দল না হয়ে সরকারের অংশ হয় অথবা বিএনপিকে সমর্থন দেয়, তাহলে সেক্ষেত্রে বিএনপি বিরোধী দল হওয়ার সুযোগ পাবে।”
আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরীক মহাজোটের দলগুলো মিলে আসন পেয়েছে ২৮৮টি। বিরোধী এবং স্বতন্ত্র মিলে বাকি থাকছে ১২টি আসন।
সেক্ষেত্রে কেমন সংসদ হবে সেটি?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, মোটা দাগে বলা যায় এটি এমন একটি সংসদ হবে যেটি একটি রাজনৈতিক দল বা জোটের একছত্র ভুবন হবে। অবশ্য দশম সংসদের তুলনায় এটিকে খুব একটা ব্যতিক্রম বলা যাবে না, কারণ তখনকার বিরোধী দলেরও একপা ছিল সরকারে, একপা ছিল বিরোধী দলে।
”ইতিবাচকভাবে ভাবলে, যদি এমন হতো যে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি মিলে একটি বিরোধী পক্ষ, তাহলে সংসদ প্রাণবন্ত হতে পারে।”
কিন্তু এতো কম আসন নিয়ে এরা সংসদে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ”বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দুই-চারটি আসন নিয়েও সংসদে প্রাণবন্ত আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশেও অতীতে সেটা হয়েছিল। তবে বাস্তবতা হলো, তার কোন লক্ষণ আমি দেখছি না। সেটার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত বলে আমার মনে হচ্ছে।”
তার মতে, সংসদে মূলত তিন ধরণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। একটি আইন প্রণয়ন বা আইনের সংস্কার, দ্বিতীয়ত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা, আর তৃতীয়ত হচ্ছে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করার ক্ষেত্র তৈরি করা।
”সংসদে যদি কার্যকর বিরোধী দলের উপস্থিতি না থাকে, তাহলে এই তিনটি ভূমিকা পালন কখনো সম্ভব হয় না,” বলছেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।